ঈশপের কয়েকটি শিক্ষণীয় গল্প

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই গ্রীসের বিখ্যাত গল্পকার ঈশপের নাম শুনেছো। তিনি ছোটদের জন্য অসংখ্য শিক্ষণীয় ও মজার গল্প লিখেছেন। ঈশপ ছিলেন মিসরের ফারাও বাদশাহ আমাসিসের সময়কার লোক। সামস দ্বীপে তিনি বাস করতেন। ইয়াডমন নামে এক নাগরিকের ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। ঈশপ দেখতে ছিলেন কদাকার কিন্তু বুদ্ধি ও হাস্যরসে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাপ্রদ অমর কাহিনীগুলো মানুষকে শোনাতেন। বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ ছিলেন তার গল্পের ভক্ত। তার মৃত্যুর পর গ্রীসের দার্শনিক জিমট্রিয়াস তার গল্পগুলো সংগ্রহ করে রাখেন। সেই থেকে ঈশপের গল্প আজও সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। রংধনু আসরে আমরা ঈশপের কয়েকটি ছোট গল্প প্রচার করেছি।  

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, শিক্ষা লাভ, চরিত্র গঠন এবং জীবন ধারণের জন্য অসংখ্য কাজের মধ্যে মানুষকে নিয়োজিত থাকতে হয়। এই চলার পথে ভদ্রতা, বিনয়, নম্র কথাবার্তা ইত্যাদির সমন্বয়ে মানুষের স্বভাবে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তাকে আদব-কায়দা বলে। আর এই আদব-কায়দা শেখার উত্তম সময় হচ্ছে শৈশব। শৈশবে পিতা-মাতা যেভাবে তাদের সন্তানের সঙ্গে ব্যবহার করবেন, তাদের মধ্যেও সেই গুণাবলি বিকশিত হবে। কারণ বাল্যকালেই শিশুর গ্রহণ ও অনুকরণ করার বয়স। তখন সে যা দেখে তাই অনুকরণ করতে শেখে। তাই তাদের সামনে সব সময় ভালো আচরণ দেখানো উচিত। পাশাপাশি মন্দ কাজগুলো থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টা করা উচিত। এসব না করলে সন্তান-সন্ততি বিভিন্ন ধরনের মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। যার পরিণাম শেষে অত্যন্ত ভয়াবহ ফল বয়ে আনে। এ সম্পর্কেই আসরের শুরুতেই একটি গল্প শোনাবো।

(অন্যায়ের প্রশ্রয়)
একটা ছেলে ছোটবেলাতেই তার মাকে হারিয়েছিল। ফলে সে তার খালার কাছেই বড় হচ্ছিল। খালা তাকে ‍খুবই আদর করত। তার মা নেই বলে অন্যায়ের পরও কেউ তাকে কখনো বকাবকি করত না। একদিন ছেলেটি স্কুলের এক সহপাঠির পেন্সিল চুরি করে এনে তার খালাকে দেখাল, খালা তাকে বকাঝকা না করে তার প্রশংসাই করল। ছেলেটি আর একবার তার কোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা ভালো জামা চুরি করে এনে তার খালাকে দিল, খালা এবার তার প্রশংসা করল। এভাবে ছোটখাট জিনিস চুরি করতে করতে ছেলেটি বড় হতে লাগল। বড় হওয়ার পরও চুরি করা অব্যাহত রাখল। এভাবে চুরি করতে করতে একদিন সে ধরা পড়ে গেল। তার চুরির বিচার হলো আদালতে। সবশুনে বিচারক তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিল। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে একজন জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কোনো সাধ আছে? কোনো ইচ্ছে থাকলে বলতে পার।”

এ সময় ছেলেটি তার পাশে কাঁদতে থাকা খালার দিকে তাকিয়ে বলল- “আমি আমার খালার কানে কানে কয়েকটি কথা বলতে চাই।”
অনুমতি দেয়ার পর ছেলেটি তার খালার কানের কাছে মুখ নিয়ে তার কানের লতি কামড়ে ছিড়ে দিল। তারপর বলল, খালা আজ তুমিই আমার প্রাণদণ্ডের কারণ। প্রথম যেদিন আমি পেন্সিল চুরি করেছিল সেদিন তুমি যদি আমাকে শাসন করতে তাহলে   আমাকে এইভাবে মরতে হতো না। আমার এই অধঃপতনের জন্য তুমিই দায়ী।

(পেট আর পায়ের দ্বন্দ্ব)
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, আমাদের শরীরের প্রত্যকটি অঙ্গের বিশেষ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা রয়েছে। একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল। বাঁচতে হলে একে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। পেট ও পায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে ঈশপ একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটি তোমাদের শোনাচ্ছি।

একদিন পেট আর পায়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল- কার শক্তি বেশি তা নিয়ে। পা পেটকে বলল, তোমাকে আমি বহন করে নিয়ে বেড়াই। তাই তোমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমারই শক্তিই বেশি।
পেট বলল, আমি খাবার খেয়ে হজম করি, তোমায় পুষ্টি জোগাই, তা না হলে তুমি হাঁটতে পারতে কি করে?
পা বলল- আমি পায়ে হেঁটে খাবার জোগাড় করি বলেই তো তুমি খাদ্য পাও।

পেট বলল- আমি তো তোমাকে পায়ে হাঁটার শক্তি জোগাই। আমি শক্তি না জোগালে তুমি কেমন করে হাঁটতে?
পা ও পেট এভাবে নানা যুক্তি দিয়ে নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণের চেষ্টা করলেও তারা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয় জীবন বাঁচানোর জন্য তার দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

(কুকুর, মোরগ আর শিয়ালের গল্প)
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ প্রবাদটা শুনেছো। এছাড়া, এ প্রবচনটিও শুনে থাকবে যে, অন্যদের যারা ফাঁদে ফেলতে চায়, তারা প্রায়ই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যায়। এ সম্পর্কে ঈশপের একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে।

এক কুকুর ও তার বন্ধু মোরগ- একবার  ঘুরতে বের হলো। ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে যাওয়ায় তারা আশ্রয়ের জন্য গভীর বনের মধ্যে চলে এল। মোরগ চড়ে বসল এক গাছের উঁচু ডালে আর কুকুর সেই গাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর হলে মোরগ অভ্যাসবশত কোঁকড়-কো বলে ডেকে উঠল।

মোরগের আওয়াজ শুনে বনের এক শিয়াল মনে মনে ভাবল- সকালের নাস্তাটা আজ মোরগের দিয়ে সেরে ফেললে মন্দ হয় না। তাই আর দেরি না করে শিয়াল ওই গাছের ডালটার নীচে চলে এল আর নানাভাবে মোরগের মিষ্টি গলার আওয়াজের সুখ্যাতি করে তার সাথে দোস্তি পাতাতে চাইল।
শিয়াল বলল: “তুমি রাজী থাকলে আজকের দিনটা তোমার সাথে কাটাতে চাই। তোমার সঙ্গ পেলে আমার খুব ভাল লাগবে।”
এ প্রস্তাব শুনে মোরগ বলল, “পণ্ডিত মশাই, এক কাজ করেন, একটু এগিয়ে এই গাছের গোড়ায় চলে যান। আমার মালপত্র যে টানে- সে ওইখানে ঘুমিয়ে আছে। তাকে ডেকে তোলেন, সে আপনাকে এখানে আসার জন্য দরজা খুলে দিবে।”

গাছের নিচ থেকে কুকুর- মোরগ আর শিয়ালের সব কথা শুনছিল। শিয়ালের মতলব বুঝতে পেরে কুকুর শিয়ালের আগমনের অপেক্ষা করছিল। শিয়াল গাছের নিচে আসামাত্রই কুকুর এক লাফে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মোরগকে নিজের ফাঁদে ফেলতে গিয়ে উল্টো কুকুরের ফাঁদে পড়ে জীবন দিল ধূর্ত শিয়াল। 

(ছাগল আর গাধা)
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, যারা অন্যের ক্ষতি করতে চায় তারা নিজের আরো বড় ক্ষতির মুখে পড়ে। এ সম্পর্কে ঈশপের একটি গল্প আছে। গল্পটি এ রকম-
একটি লোকের ছিল একটি ছাগল আর এক গাধা। মালিক গাধাটার ব্যাপক যত্ন নিত, ভালো ভালো খাবার খেতে দিল। তা দেখে ছাগলটা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যেত। একদিন সে গাধাটাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটা ফন্দি আঁটল। গাধাটাকে ডেকে বলল, “তোমার জন্য দুঃখ হয় বন্ধু, কী খাটুনিটাই না তোমাকে দিয়ে খাটায় এরা! একবার তোমাকে পেষাই করার যন্ত্রে জুড়ে দিচ্ছে তো আরেকবার কাঁড়ি কাঁড়ি বোঝা টানাচ্ছে। তুমি যদি এ অবস্থা থেকে বাঁচতে চাও তাহলে মৃগীরোগীর ভান করে কোনো একটা খাদে নেমে খানিক বিশ্রাম নাও।”

ছাগলের পরামর্শ গাধার খুব মনে ধরল। কিন্তু খাদে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে চোট লেগে নানা জায়গায় কেটে গেল তার। গাধার মালিক খবর পাঠাল সেখানকার হাতুড়ে চিকিৎসককে। চিকিৎসক হুকুম দিল ছাগলের রক্ত যোগাড় করার জন্য। তার মত হলে গাধার ক্ষতের ওপর ছাগলের রক্ত ঢালতে পারলেই গাধা ভালো হয়ে যাবে। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী মালিক তার নিজের ছাগলকেই জবাই করে গাধাকে সারিয়ে তুলতে লেগে গেল।
ছাগল চেয়েছিল তার কুবুদ্ধির কারণে মালিক গাধাকে শাস্তি দেবে। কিন্তু গাধাকে কুবুদ্ধি দেয়ার পরিণতিতে তার যে জীবন যাবে তা ভাবতে পারেনি ছাগলটি।

(দাড়কাক ও ময়ুর)

বন্ধুরা, আজকের আসরের শেষ গল্পটি এক দাড়কাক ও ময়ুরের। এক বনে বাস করত একটি দাড়কাক। উড়ে যাবার সময় তার নজর পড়ল একদল ময়ুরের দিকে। ময়ুরের পেখম দেখে সে মুগ্ধ। তারও খুব ইচ্ছে হল ময়ুরের দলে যোগ দিতে কিন্তু সে তো দাড়কাক!
এরপর সে ময়ুরের পেখম কুড়িয়ে নিয়ে নিজের গায়ে লাগাল এবং ময়ুরের দলে ভিড়তে চাইল কিন্তু ময়ুর তাকে চিনতে পেরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। মনের দুঃখে সে ফিরে গেল তার দাড়কাকের দলে। কিন্তু তার শরীরে ময়ুরের পেখম দেখে তারাও তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। মনের দুঃখে সে একাই থাকতে লাগলো, কেউ তাকে আর আপন করে নিল না।
এ গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, আল্লাহ যাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তার সেভাবেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। অন্যের অনুকরণ করতে গেলে বিপদ হতে পারে।#

রেডিও তেহরান/এআর/২২

Comments

Popular posts from this blog

**একটা উপদেশ মূলক গল্প**

"একটি শিক্ষা মুলক গল্প"

উপদেশ মূলক ছোট গল্প