এক রাজা ও একটি গাছের বীজ

পাঠক! এটি একটা গল্প হলেও কিছু শিক্ষনীয় বিষয় আছে আমাদের সন্তানদের গল্পের ছলে এই শিক্ষা দিতে পারি। গল্পটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত না পড়লে হয়তো সেই শিক্ষার বিষয়টি আপনার অজানা থেকে যাবে। তাই অনুরোধ ধৈর্য সহকারে গল্পটি শেষ পর্যন্ত পড়বেন।
এক দেশে ছিল এক প্রতাপশালী রাজা। রাজা যেমন ছিল প্রতাপশালী তেমনি ছিল নৈতিক চরিত্রবান। একদিন রাজা তার সভাসদদের ডেকে বললেন,
“আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি এখন আমার উত্তরসুরী হিসেবে নতুন রাজা নির্বাচন করা দরকার।”
এই কথা শুনে সভাসদ সবাই হতবাক। সভাসদ সবাই বলে উঠলো,
“রাজা মহাশয় আপনি তার নাম বলুন আমরা তার আজ্ঞাবহ হয়ে যাব।”
রাজা বললেন,
“সেটাই তো সমস্যা। কার নাম বলবো, কাউকে তো আমার মত দেখছি না।”
এই কথা শুনে সভাসদ সবাই আবারও অবাক। তারা ভাবছে রাজার এতগুলো সন্তান থাকতে রাজা তার মত কাউকে দেখছে না কেন? হঠাৎ রাজা সভাসদকে হুকুম দিলেন যে রাজ্যের যত কিশোর বালক আছে তাদেরকে দরবারে হাজির করতে। যথারিতি একদিন রাজ্যের সকল কিশোরদের হাজির করানো হলো। রাজা সকল কিশোরদের উদ্দেশ্য ঘোষনা করলেন,
“শোন বাছা আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমি চাই তোমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন রাজ্যের রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করো। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কে রাজা হবার যোগ্যতা রাখ তা আমি কিভাবে জানবো। সেটা বের করার জন্য তোমাদের এখানে ডেকেছি।”
এই ঘোষনা শুনে সব কিশোররা তো মহা খুশি সাথে তাদের বাবা/মারাও। সবাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিল যে সে এই রাজ্যের রাজা হতে চলেছে। এবার রাজা গম্ভীর কন্ঠে আবার ঘোষনা করলেন,
“আমি তোমাদের একটা পরীক্ষা করবো যাতে আমি বুঝতে পারি তোমাদের মধ্যে কে রাজা হবার যোগ্যতা রাখ।”
শিশুরা সবাই আনন্দিত হলো। এটা কোন সমস্যা না। এবার রাজা প্রত্যেক কিশোর বালকদের হাতে একটা করে গাছের বীজ দিলেন, আর ঘোষনা করলেন,
“তোমরা এই বীজ নিয়ে বাড়ীতে টবে লাগাবে। সেটার যত্ন নেবে, তারপর এক বছর পর তোমরা এই বীজ থেকে যা পেলে তা সাথে করে এই দরবারে আবার আসবে। তখন আমি তোমাদের বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”
বীজ হাতে নিয়ে কিশোর বালক আর তাদের বাবা/মা বেজায় খুমি মনে বাড়ীতে ফিরে গেল। সভাসদের সকলেই বিষয়টা অনুধাবন করতে না পেরে হতাশায় পড়ে গেল। বিষয়টা কি?
এই কিশোর বালকদের মধ্যে একজন বালকের নাম “লিঙ্ক”। সবার মত লিঙ্কও বীজ নিয়ে এসে বাড়ীতে একটা টবে বীজটা বপন করে দিল। লিঙ্কের মাও লিঙ্ককে গাছ জন্মানোর সবরকম সহযোগিতা করতে লাগলো। লিঙ্ক প্রতিদিন পানি দেয়। পরদিন স্কুলে গিয়ে অন্যান্য বন্ধুদের কাছে তাদের বীজের বিষয় নিয়ে আলাপ করে। ৪ সপ্তাহ, ৬ সপ্তাহ এভাবে ২ মাস ৬ মাস কেটে যায় লিঙ্কের টবের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে না অথচ অন্যান্য বন্ধুদের টবের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বেশ বড় সড় গাছ হয়ে গেছে। লিঙ্ক বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। লিঙ্কের মা লিঙ্ককে সান্তনা দিতে লাগলেন যে হয়তো তার বীজ গজাতে সময় নেবে। লিঙ্কও তাই মনে করে ধৈর্য সহকারে বীজের পরিচর্চা করতে লাগলো। প্রতিদিন স্কুলে বন্ধুদের কাছে তাদের গাছের বিষয় গল্প শুনে লিঙ্ক প্রায় হতাশায় পড়লো। লিঙ্ক তার বীজের বিষয় বন্ধুদের বলে না। এভাবে বছর কেটে গেল কিন্তু লিঙ্কের বীজ থেকে আর গাছ জন্মায়নি। তারপর আবার এক বছর পর রাজা তাদের ডাকলেন। সবাই তাদের নিজ নিজ সুন্দুর বড় আকারের ফুলে ফলে শোভিত গাছ নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হলো। লিঙ্ক তার শুন্য টব নিয়ে যেতে রাজী নয়। তারপরও সে মায়ের অনুরোধে তাই নিয়ে গেল। সকল বন্ধুরা লিঙ্কের শুন্য টব দেখে হাসা হাসি করতে লাগলো। কেউ কেউ টিজ করলো। কিন্তু লিঙ্ক ভয়ে ভয়ে তার শুন্য টবটি নিয়ে সবার পিছনে দরবারের এক পিলার পাশে কোন মতে লুকিয়ে থাকলো যাতে রাজা তাকে দেখতে না পারে।
রাজা দরবারে এসে সকলের ফুলে ফলে শোভিত গাছ দেখে বেশ মোহিত হয়ে গেলেন। রাজা সব কিশোর বালকদের বেশ উৎসাহ দিলেন। রাজা বলে উঠলেন,
“তোমরা বেশ যত্ন নিয়েছ তোমাদের গাছগুলোর। কি সুন্দর ফুল আর ফল তাতে। আমি মুগ্ধ।”
এই কথা বলে রাজা আশপাশ তাকাতেই নজর পড়লো পিলারে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লিঙ্কের প্রতি। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুমি কেন ওখানে ওভাবে লুকিয়ে আছ? বের হয়ে আস। কি সমস্যা তোমার?”
লিঙ্ক দেখলো সে রাজার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তাই সে তার শূন্য টবটি নিয়ে ধীরে ধীরে রাজার সামনে এসে দাঁড়ালো। শুকনো মুখ নিয়ে লিঙ্ক যথেষ্ট জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন
“কি নাম তোমার?” উত্তরে সে বললো,
“আজ্ঞে আমার নাম লিঙ্ক।”
রাজা খুব নিখুত ভাবে লিঙ্কের টব পরীক্ষা নীরিক্ষা করলেন এবং সেই বীজটি টবের মাটির তলা থেকে বের করে আনলেন। এটা দেখে দরবারের সবাই বেশ হাসিতে ফেটে পড়লো। রাজা নিজেও অট্রহাসিতে ফেটে পড়লেন। সবার হাসি দেখে লিঙ্ক ও তার মা অপমানিত বোধ করে আরো জড়োসড়ো হয়ে পড়লো।
এবার রাজা বেশ গুরুগম্ভীর গলায় কথা বলে উঠলেন,
“তোমাদের গাছ পরিচর্চায় আমি মুগ্ধ ও অভিভুত হয়েছি। কিন্তু আমি তোমাদের সবাইকে সিদ্ধ করা বীজ দিয়েছিলাম যা থেকে কোন ধরনের গাছ জন্মানোর কথা নয়। কিন্তু তোমরা সে বীজ পরিবর্তন করে ভাল বীজ বপন করে গাছ জন্মিয়েছ। অথচ এই লিঙ্ক সে সত্য জিনিষ নিয়ে এসেছে। কাজেই আমি দেখছি লিঙ্ক হচ্ছে সত্যবাদী ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। আর রাজা হবার জন্য দরকার একজন নৈতিক চরিত্রবান ও সত্যবাদী মানুষ। সে বিবেচনায় আমি লিঙ্ককেই আমার পরবর্তি রাজা হিসেবে নির্বাচন করলাম।”
পাঠক! এই গল্পটি বলার কারন একটি হাদিসকে তুলে ধরার জন্য। হাদিসটিঃ আমাদের রসুল (সাঃ) বলেছেন যে “সত্যবাদিতা একজন মানুষকে সৎচরিত্রবান হতে সাহায্য করে, এবং একজন সৎচরিত্রের পথে চালিত মানুষ বেহেশতের দিকেই অগ্রসর হয়। এবং একজন মানুষ ততক্ষন পর্যন্ত সত্যকথা বলে যতক্ষন পর্যন্ত সে একজন সত্যবাদী সৎচরিত্রবান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অন্যদিকে মিথ্যা একজন মানুষের নৈতিক চরিত্রকে সর্বদা দুর্বল রাখে এবং শয়তানের পথে চালিত করে। আর দুর্বল নৈতিক চরিত্র একজন মানুষকে সর্বদা দোযকের দিকে নিয়ে যায়। এবং একজন মানুষ ততক্ষন পর্যন্ত মিথ্যা বলতে থাকে যতক্ষন না আল্লাহ সোবহানা তালা তার নামের সামনে “মিথ্যাবাদী” না লিখেন” (সহি বুখারী, ভলিউম ৮, হাদিস নং ১১৬)

Comments

Popular posts from this blog

**একটা উপদেশ মূলক গল্প**

"একটি শিক্ষা মুলক গল্প"

উপদেশ মূলক ছোট গল্প