টিনের সেপাইর গল্প

 টিনের সেপাইয়েরকথা

এক সময় পঁচিশটা টিনের সেপাই ছিল। তারা সবাই ভাইভাই, কারণ সবাই একটা পুরনো টিনের হাত গলিয়ে তৈরি। সবার হাতেবন্দুক, সবাই তক্তার মতো খাঁড়া দাড়িয়ে, সকলেরলাল আর নীল সৈনিকের পোশাক, সবাই দেখতে ভারি মজাদার। পৃথিবীতেজন্ম নেবার পর, যেই ওদের বাক্সের ঢাকনি খোলা হল, অমনি প্রথমযে কথা ওদের কানে গেল, তা হল, ‘টিনেরসেপাই ! একটি ছোটো ছেলেআনন্দে হাততালি দিয়ে ঐ কথা বলল। সেপাইগুলোকে সেজন্মদিনে উপহার পেয়েছিল। তার পর সে টেবিলের উপরেতাদের সাজিয়ে রাখল। সেপাইদের মধ্যে একচুল তফাত নেই। শুধুএকটা অন্যদের চাইতেএকটু অন্যরকম, কারণ তার মোটে একটা ঠ্যাং। ওকেই কিনা সবার শেষেতৈরি করা হয়েছিল, টিনে কুলোয় নি বলে। সেযাই হোক, অন্যরা দুঠ্যাঙে যেমন মজবুত হয়ে দাঁড়িয়েথাকত ওর এক ঠ্যাঙেও ওতেমনি মজবুত হয়ে দাঁড়াত। আমার মনে হয় ওরইজীবনের নানান ঘটনা তোমাদের শোনাবার যোগ্য । যেটেবিলে টিনের সেপাইরা সাজানো ছিল, তাতেআরো কয়েকটা খেলনাও ছিল। তার মধ্যেসবচাইতে সুন্দর হল পীচ- বোর্ডের তৈরি চমৎকার একটা দুর্গ। দুর্গের ক্ষুদে-ক্ষুদেজানলা দিয়ে ঘরের ভিতরেদেখা যেত। দুর্গের সামনে, একটা ছোটো আয়নার চারদিকে ভিড় করে ছিল কয়েকটা ক্ষুদেগাছ। আয়নাটাকে একটা দীঘি মনেকরতে হবে। কয়েকটা মোমের রাজহাঁস ঐ দীঘির জলে সাঁতার কাটত, জলে তাদের ছায়া দেখা যেত । এ-সবইখুব চমৎকার সন্দেহ নেই, কিন্তু তার মধ্যে সবচাইতেসুন্দর জিনিসহল ছোটো একটি মেয়ে। সে দুর্গের খোলা দরজার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকত। সেও পাঁচবোর্ড কেটে তৈরি, কিন্তু তার পরনেছিল খাটি মসলিনের জামা, তার কাঁধের উপর চাদরের মতো করে ফেলা ছিল একটুখানি ফিকেনীল রেশমী ফিতে, আর সেই ফিতের ঠিক মধ্যিখানে ছিলএকটা ঝকঝকে সোনার ডানা।

এই ক্ষুদে মহিলাটি হল একজন নর্তকী, তাইসেহাত দুটিকেবাড়িয়ে ধরেছিল, আর একটা পা এত উঁচুতে তুলেরেখেছিল যে টিনের সেপাই সেটিকে দেখতে না পেয়ে ভাবত ঐ মেয়েটিরও বুঝি তারই মতো মোটেএকটি পা । সে মনেমনে বলত, “ঐ তো ঠিক আমার বউ যেমন হওয়া উচিত। মুস্কিল হল, ওর বংশ বড়ো উঁচু। ও থাকেদুর্গে আর আমি থাকি শুধুএকটা বাক্সে। তারউপর বাক্সাঁএাঁ আমারও নয়, ওরমধ্যে আমরা পঁচিশজন থাকি ; ওখানে তো আর বউ আনা যায় না। সে যাই হোক গে, ওর সঙ্গে আলাপ করতে দোষ কি ? এই-সব ভেবে টেবিলের উপরেরাখা একটা নস্তির কোঁটোর পিছনেগিয়ে টিনের সেপাই দাঁড়াল। এই জায়গাটা থেকে পাতলা ছোটো মহিলাটিকেএকেবারে সামনাসামনি দেখা যেত। সে তখনো এক পায়েই দাঁড়িয়ে ছিল, অথচ টাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল না। সন্ধেবেলা সব টিনের সেপাইদের বাক্সে ভরে, বাড়ির লোকেরা শুতে গেল। তখন খেলনাগুলোর পালা, তারা এবার খেলা শুরু করল। তারা খেলা করতে লাগল যেন এ-ওর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে, যেন যুদ্ধহচ্ছে, নাচের আসর বসেছে। টিনের সেপাইরা বাক্সের ভিতর থেকেঝনঝন শব্দ করতে লাগল, তাদেরও বেরিয়ে এসেখেলা করার ইচ্ছা, কিন্তুবাক্সের ঢাকনিটাকেকিছুতেই খুলতে পারছিল না। বাদাম ভাঙার জাতিটা ডিগবাজি খাচ্ছিল, শ্লেট-পেনসিলটা শ্লেটের উপর বেচাকেনা খেলছিল। সব মিলিয়ে এমনি হটগোল শুরু হয়ে গেল যেক্যানারি পাখিটার ঘুম ভেঙে গেল, অমনি সেও কথা বলতে আরম্ভ করল, অবিশ্যি সে সর্বদা ছড়া কেটে কথা বলত। মাত্র দুজন নিজেদের জায়গা থেকেএতটুকু নড়ল না ; তারা হল সেই ছোটো টিনের সেপাই আর সেই সুন্দরী নর্তকী। সে সব সময় ঐ এক সুন্দরভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকত, এক পায়ের আঙলে ভর করে, হাত বাড়িয়ে। এদিকে সেপাইয়ের কথা আর কি বলব, সে সারাক্ষণ তার এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতআর সুন্দরী মেয়েটির উপর থেকেকখনো চোখ ফেরাত না। রাত বারোটা বাজল। অমনি খটকরে নস্তির কৌঁটোর ঢাকনি খুলে গেল। কৌটোর ভিতরে নস্তি ছিল না ; তার বদলেছোটো একটা কালো রঙের জাদুকর লাফিয়ে উঠল ; ওটা আসলে একটা খেলনা, ওকে ‘জ্যাক্‌-ইন-দি-বক্স’ বলে। জাদুকর বলল, “ও হে টিনের সেপাই, চোখদুটো সামলাও !” কিন্তুটিনেরসেপাই ভাব দেখাতেলাগল যেন কিছু শুনতেইপায় নি । জাদুকর বলল, “আচ্ছা ! কাল অবধি অপেক্ষা করেই দেখনা কি হয় ।” সকাল হলেছেলেমেয়েরা বিছানা থেকে উঠেপড়ল । টিনেরসেপাইকে তুলে নিয়েতারা জানলার চৌকাঠের উপর রেখেদিল, আর তখুনি, সেজাদুকরের জন্যেই হোক, কিংবা বাতাসের জন্যেই হোক, জানলাটা দুড়ুম করে খুলে গেল আর পা উঁচুতেমাথা নিচুতেকরে সেই তিনতলারউপরথেকে, টিনের সেপাই মাটিতে পড়ল । সে কি ভয়ংকর পড়া! ৰেচারার একমাত্র ঠ্যাংটা শূন্যেঘুরপাক খেতে লাগল, তারপর যখন মাটিতে পৌঁছল তখন সেপাই টুপিতে ভর করেপা ওপরে করেপড়ল, আর বন্দুকের সঙ্গিনটা রাস্তারশানেরমধ্যে ঢুকে রইল ।

তখুনি ঝির সঙ্গেছোটো ছেলেটা ওকে খুজতেনীচেনেমে এল, কিন্তুতাকে দেখতেই পেল না যদিওআরেকটু হলেই ওরা তাকে মাড়িয়ে দিত। সেই সময় টিনের সেপাই যদি চেঁচিয়ে বলত, “এই যে, আমি এখানে!” তা হলেই ওরা ওকে খুঁজে পেত, কিন্তুসে ভাবল সৈনিকের পোশাক পরেওভাবেচ্যাঁচানটা ঠিক হবে না। তার পর বৃষ্টি পড়তেআরম্ভ করল ;একেকটা ফোটা পড়েযেন তারআগের ফোটার চাইতেওজনেবেশি ! ঝম্‌ঝম করেবৃষ্টি পড়ে সব ভিজিয়ে সপসপে করেদিল । বৃষ্টি থামলে, দুটো ছেলে এদিকে এল। একজন বলল, “দেখেছ, একটা টিনের সেপাই ! জীবনে এই একবারের মতো বেচারা নৌকো চেপে বেড়াতে যাক ৷” এই বলে তারা পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে একটা নৌকো বানিয়ে, তার মধ্যে টিনের সেপাইকে চাপিয়ে দিল। অমনি নর্দমার জলের সঙ্গে নৌকো ভেসে চলল ; ছেলেদুটো হাততালি দিতেদিতে, পাশেপাশে দৌড়তে লাগল। কাগজের নৌকো জলে দোল খেতে লাগল আর মাঝেমাঝেহঠাৎ এমনি পাক খেল যে টিনের সেপাইয়ের মাথা ঘুরতে লাগল। তবুসে এতটুকু নড়ল-চড়লনা ; বন্দুকের সঙ্গিন শক্ত করেধরে, সটান সামনের দিকে তাকিয়েরইল । এক জায়গায়নালার উপর তক্তা পাতা ছিল, তারতলা দিয়ে নৌকো ভেসে চলল। টিনেরসেপাই দেখল এজায়গাটা বাড়িতেতার বাক্সের ভিতরটার মতোই অন্ধকার । সে মনে মনেবলল, ‘এবার কোথায়যাচ্ছি কে জানে! এ-সবই নিশ্চয় ঐ জাদুকরের কাজ ! আহা, ঐ মেয়েটি যদি আমার সঙ্গে এই নৌকোয়থাকত, তা হলে এর দুগুণ অন্ধকারেওআমার এসে যেতনা ?একটা জলের ইঁদুর ঐ তক্তার নীচে থাকত; সেতার বাসা থেকেছুটে এসে বলল, “পাসপোর্টআছে? কই, দেখি তোমার পাসপোর্ট?” টিনেরসেপাই কোনো কথা বলল না, খালি হাতের অস্ত্রটাকে আরো শক্ত করেধরল। নৌকো ভেসে চলল, ইঁদুরও পিছন পিছন চলল। উঃ! সেকি বিকটভাবেসেদাঁত খিঁচিয়ে, জলেভেসে যাওয়া খড়-কুটোকে বলতে লাগল, “ওকে থামাও ওকে থামাও! ও পারের কড়ি দেয় নি, পাসপোর্ট দেখায় নি!” এদিকে স্রোতের বেগ বাড়তে লাগল। টিনের সেপাই দূরে ঝকঝকে রোদ দেখতে পেল ; ঐখানেই নৌকোটা সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেসেকি ভয়ংকর গর্জন ! অমন আওয়াজ শুনলে অতি বড়ো বীরওভড়কেযেত! সুড়ঙ্গ যেখানেশেষ হয়েছে, ঠিক সেইখানেই নালার জলওহুড়হুড় করে মস্ত একটা খালের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। একটা মস্ত জলপ্রপাত বেয়ে নৌকোয় নামা আমাদের পক্ষে যতটা বিপদের কথা, টিনের সেপাইয়ের পক্ষে নালা থেকে খালেপড়াও তাই। ততক্ষণে কাগজের নৌকোটা জলপ্রপাতের এত কাছাকাছি এসে পড়েছিলযে টিনের সেপাই আর দাঁড়িয়ে থাকতেপারছিল না। নৌকোটা ছিটকেএগিয়ে চলল, টিনের সেপাই বেচার যতটা পারে আড়ষ্টঅনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ; কেউ বলতে পারবেনা যে একটি বারের জন্যেও তার চোখের পলক পড়েছিল। নৌকোটা তিনবার—না তিনবারনয়, চারবার— ঘুরপাক খেল, কানায় কানায় জলে ভরে গেল ; এবার নৌকো ডুববে !

টিনের সেপাই গলাজলে দাঁড়িয়ে ছিল ; ক্রমে নৌকো আরো তলিয়ে যেতে লাগল, কাগজ আরো নরম হয়েএল, সেপাইয়ের মাথার উপর দিয়েজল বয়ে গেল। তখন তারসেই সুন্দরী নর্তকীর কথা মনে হল, তার সঙ্গে আর দেখা হবেনা । টিনের সেপাইয়েরকানে এই কথাগুলো বাজতে লাগল, দুরন্ত অভিযান, সঙ্কট মহান, কপালেতে লেখা, অচিন মহাপ্রাণ ! তার পর কাগজটা ছু-টুকরো হয়ে গেল, ফাঁক দিয়ে গলে টিনের সেপাই পড়ে গেল। অমনি একটা মস্ত মাছ তাকে গিলে ফেলল। সেকি অন্ধকার! নালায় পাতা তক্তার তলাতেও এত অন্ধকার ছিল না, আর কি বেজায় সরু জায়গা ! কিন্তু টিনের সেপাইয়ের কোনো আলি-বালি নেই, বন্দুক কাঁধে নিয়েই সে লম্বা হয়ে শুয়েরইল । মাছটা এদিকেফেরে, ওদিকে ফেরে, কিলবিল করেঅদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি করে। তার পর হঠাৎ যেন একেবারে থেমেগেল, তার শরীরের মধ্যে দিয়েএক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার পরেই ঝকঝকে দিনেরআলো ! কে যেন বলে উঠল, “আরে, টিনের সেপাই যে ”ইতিমধ্যে মাছটা ধরা পড়েছিল; তাকে বাজারে নিয়েগিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল ; তার পর রান্নাঘরেনিয়েগিয়ে, মস্ত একটা ছুরি দিয়ে দাসী তাকেকুটতে বসেছিল। এবার সে দুই আঙুলে করেতার কোমর ধরে, তাকেএকেবারেবসবার ঘরে নিয়ে গেল। মাছের পেটে ভ্রমণ করে এসেছে এমন আশ্চর্য মানুষ দেখতে সবার কি আগ্রহ ! কিন্তু আমাদের সেই ক্ষুদে যোদ্ধার মনেএতটুকু অহংকার হল না। ওরা ওকে একটা টেবিলের উপর রাখল আর সেখানে—না, এমন আশ্চর্য ব্যাপার কি পৃথিবীতেকখনো ঘটে? টিনের সেপাই দেখল সে আবার তারসেই পুরনো ঘরেই ফিরে এসেছে, যেখানেসে আগেও ছিল। দেখল সেই একই ছেলেমেয়ে, টেবিলের ওপর সেই একই খেলনা, তার মধ্যে সেই চমৎকার দুর্গে সেই সুন্দরী ছোটো নর্তকী, এখনো সে একপায়েদাঁড়িয়ে, আরেক পা শূন্যে উঁচুকরে রেখেছে; তারও কোনো অদলবদল নেই। তাই দেখে টিনের সেপাই বড়োই অভিভূত হয়ে পড়ল ; ইচ্ছা করলেই সে টিনের চোখের জলও ফেলতে পারত, কিন্তুসেরকম ব্যবহার তো আর টিনেরসেপাইকে শোভা পায়না ! সেপাইমেয়েটির দিকেতাকাল, মেয়েটি সেপাইয়ের দিকেতাকাল, কিন্তুকেউ কোনো কথা বললনা। হঠাৎ ছোটো ছেলেগুলোরমধ্যে একজন টিনের সেপাইকে তুলেনিয়ে, কথা নেই বার্তা নেই, একেবারে উনুনের মধ্যেফেলে দিল। কেন এমন করল, তার কোনো কারণ দেখালনা সে, কিন্তু নিঃসন্দেহে এর মধ্যে নস্তিরকোঁটোর জাদুকরের হাত ছিল । এক ঝলক লাল আলোর মাঝখানে টিনের সেপাই দাঁড়িয়ে রইল।

তারবেজায় গরম লাগছিল, তবে সেটা সত্যিকার আগুনের জন্য, নাকি তার মনের ভিতরকার ভালোবাসার আগুনের জন্য, সে নিজেও জানত না। তার গায়ের সব রঙ জ্বলে গিয়েছিল। সেটা নানান জায়গায় ভ্রমণ করার সময়ই হয়েছিল, নাকি আবেগের আতিশয্যে হয়েছিল, তা জানি না। সে ছোটো নর্তকীর দিকে চাইল, ছোটো নর্তকী তারদিকে চাইল ; সেপাই টের পেল সে গলেযাচ্ছে, তবু তার অদলবদল নেই, বন্দুক কাঁধে করেখাঁড়া দাঁড়িয়ে রইল। তার পর কে যেন দরজা খুলতেই, মেয়েটি বাতাসেউড়ে, আকাশের পরীর মতো সোজা উনুনের মধ্যে টিনের সেপাইয়ের কাছে চলেএল। সঙ্গে সঙ্গে দুজনে জ্বলে উঠে, একেবারে মিলিয়ে গেল। টিনের সেপাইগলে গিয়ে ছাইয়ের উপর ফোট-ফোটা হয়ে পড়তে লাগল। পরদিন সকালে দাসী যখন উনুনের ছাই বেরকরেনিয়ে গেল, দেখল সেপাইয়ের টিনের শরীরগলে গিয়েছোটো একটি হরতনেরমতো হয়ে আছে। সুন্দরী নর্তকীর শুধুসোনালি ডানাটি বাকি ছিল, তাও জ্বলেপুড়ে কালো কয়লার মতো হয়ে গিয়েছিল ।

Comments

Popular posts from this blog

**একটা উপদেশ মূলক গল্প**

"একটি শিক্ষা মুলক গল্প"

উপদেশ মূলক ছোট গল্প