মধুরেন সমাপয়েত

বাংলাদেশ আসলে তলাবিহীন ঝুড়ি। নিয়মকানুনের বালাই নেই। হরতালের ঠিক-ঠিকানা নেই, রাজনীতিকদের কথার লাগাম নেই। প্রতিশ্রুতির মূল্য নেই। রাস্তায় শত মানুষের সামনে একজনকে কুপিয়ে মেরে ফেললেও তার বিচার নেই। দিনদুপুরে বাসায় ঢুকে শিশুকন্যার সামনে মা-বাবাকে মেরে রেখে গেলেও তার হদিশ নেই।
এখানে শেয়ার মার্কেটের জবাবদিহিতা নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা অর্থ পাচারের কূলকিনারা নেই। এখানে মানুষের পয়সায় বানানো রাস্তা-সেতু ভিত্তি প্রস্তরের পর আলোর মুখ দেখে না প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এখানে রাস্তায় পানি জমে-সেই মফস্বলের গলিঘুপচি থেকে শুরু করে আমেরিকান এম্বেসির সামনে পর্যন্ত। এখানে ইলেক্ট্রিসিটির নামগন্ধ নেই আর পানিতে দুর্গন্ধের অভাব নেই। সারি সারি বিল্ডিংয়ের পেছনে পরিকল্পনা নেই।
চাঁদাবাজ বা অপহরণের শাস্তি নেই। জমি দখল, এসিড সন্ত্রাস বা যৌতুকে নিঃস্বের আইনি আশ্রয় নেই। যখন তখন যেখানে সেখানে যানজটের কোনো ব্যাখ্যা নেই। ছুটিতে কোথাও গেলে নিরাপত্তা নেই; পর্যটনকেন্দ্র্রে এতটুকু হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা নেই।
এমনি হাজারো না থাকার দোষে অনেকেই চলে যেতে চায় বস্তাপচা এই দেশ ছেড়ে। দোষারোপ করে কখনো চায়ের টেবিলে, কখনো টিভির সামনে, কখনো সরকারকে, কখনো ভাগ্যকে, কখনো ঈশ্বরকে।
তবে কি, আল্লাহ আর সবকিছুর সাথে এই দেশে বু-উ-ক ভরা আবেগ দিয়ে দিয়েছেন। কখনো যদি ভিনদেশের স্টেডিয়ামে বাজে ‘আমার সোনার বাংলা’- মুহুর্তে দর্শক সারিতে বসে আমাদের চোখ ভিজে ওঠে।
আমরা উন্নত হই, হাজার কোটি টাকা কামাই, কিন্তু বছরে এক প্লেট সাদা ভাতের জন্যে হাহাকার কমে না। আমরা পথে নেমে আসি-সামরিক জান্তার সামনে বুক পেতে দেই-কামানের গোলায় ক্ষতবিক্ষত হই-কারণ আমার মুখের ভাষাকে কেউ যেন বদলে দিতে না পারে। আমরা গরিব হই-দামী গাড়ি কিনতে না পারি-কিন্তু বৈশাখে এক পিস মাছ না খেলে আমাদের চলে না।
আমরা যত বড়ই হই, বুড়োই হই বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারি। বাবা বৃদ্ধ হোক, জালেম হোক, অন্ধ হোক-বাবার জন্যে টেবিলে জায়গা থাকে। মাকে খাবারের আবদার জানাই। মায়ের হাতের গরুর-ভুনা আমাদের ফাইভ স্টারের চেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয়।
আমাদের খেলোয়াড়ের সাথে বিদেশি আম্পায়ার অবিচার করলে আমরা পুরো দেশ একসাথে হই-আমাদের টাকা দরকার নেই, ট্রফি দরকার নেই-আমরা আমাদের ছেলেদের বিদেশের মাঠে অপমানিত হতে দেব না। আমরা এখনো পাড়ার লোকজনকে নিয়ে গালগল্পে দিন কাটাই। পাড়ার খালাম্মা মারা গেলে দাফনের জন্যে ছেলের অভাব হয় না। রিক্সা উল্টে কেউ পড়ে গেলে আমরা জাত-পাত না জেনে ছুটে যাই। কোন সিএনজিকে লাগিয়ে দিলে আমরা সবকিছু ফেলে ট্রাক ড্রাইভারকে ধরতে ছুট দেই।
আমাদের কত্ত আবেগ! আমাদের রাগ বেশি, অভিমান বেশি, ভালবাসা বেশি, ঘৃণাও বেশি। বাইরের দেশে আমাদের তরুন ছেলেরা যায়-চার বর্গফুট জায়গায় তারা না খেয়ে, কষ্ট করে বছরের পর বছর টাকা পাঠায় দেশে মায়ের কাছে, স্ত্রীর কাছে, সরকারের কাছে। আমাদের সোনার টুকরো ছেলেরা জাতিসংঘের মিশনে যায়। আমরা তাদের হাহাকার শুনি না।
আমরা জানি না হাজার মাইল ওপারের এক দেশে জানের ভয়ে কোনো এক বাইশ বছরের তরুন যুদ্ধ করছে আর প্রতি মিনিটে টাকা কামিয়ে পাঠাচ্ছে এই দেশে। দেশের প্রতি, পরিবারের প্রতি বাধাহীন এই ভালবাসার নজির আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের দেশের এক তরুণী বিশ বছরেই সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসার চালায়। জীবনভর এই ত্যাগ কি তার হাসি দেখে আমরা ধরতে পারি?
আমরা চুপচাপ অনেক কিছুই সয়ে যাই-কিন্তু নিরীহ এক কিশোর যখন গুলিতে আহত হয়ে পা-হারায়- আমরা ফেটে পড়ি। আমাদের এক মেয়েকে যখন সীমান্তে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়-আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাই। আমরা জানি না লিমন কে, আমরা জানি না ফেলানি কে-আমরা কেবল জানি সে আমার দেশের একজন। তা-ই যথেষ্ট।
সিডরে যখন এই দেশটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়-আমার দেশের কেউ একজন বেনামে হাজার-কোটি টাকা দান করেন! এই তুলনা বিশ্বে দ্বিতীয়টা নেই। আমরা যত দূরেই যাই-এয়ারপোর্টে কোনো বাঙালি দেখলে আমরা বাংলায় জানতে চাই ‘কেমন আছেন?’ আমার ছেলেকে আমি বাংলায় শেখাই ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’.....আর স্বপ্ন দেখি সে একদিন তার সন্তানকে শেখাবে ভালবাসতে, বাংলায় ভালবাসতে।
এই আবেগ বিশ্বসেরা। আমরা ভুলে যাই আমাদের সব নীচতা-ক্ষুদ্রতার পরও আমরা একসাথে থাকি, আমাদের যে-কোনো পার্বণ পরিবার-বন্ধু-আত্মীয় ছাড়া অসম্পূর্ণ। এজন্যেই সবকিছুর পরও আমি চাই আমার সন্তান যেন এই দেশের সংস্কৃতি শিখে। কারণ ভালবাসার মাপকাঠিতে তৃতীয় বিশ্বের এই গরিব দেশটাকে কেউ ছাড়াতে পারে নি।
গেল বছরের মধুর সমাপ্তি হোক, নতুন বছরের হোক মধুর সূচনা। আর নতুন বছর যেন “বাংলায় ভালবাসি, বাংলাকে ভালোবাসি...বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই.. বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার...আমি একবার দেখি, বার বার দেখি – দেখি বাংলার মুখ”।

Comments

Popular posts from this blog

**একটা উপদেশ মূলক গল্প**

"একটি শিক্ষা মুলক গল্প"

উপদেশ মূলক ছোট গল্প